মোহাম্মদ মামুন উদ্দিন(হাতিয়া, নোয়াখালী)
নোয়াখালীর দ্বীপ উপজেলা হাতিয়ার নৌপথে যাত্রী পরিবহন এখন যেন এক মৃত্যু-ফাঁদ। লাইসেন্স ও ফিটনেসবিহীন স্পিডবোটে প্রতিদিন যাত্রী পরিবহন চলছে অনিয়ন্ত্রিতভাবে, আর এই চিত্রের পেছনে কাজ করছে একাধিক শক্তিশালী সিন্ডিকেট।
স্থানীয় ঘাটে থাকা একাধিক সূত্রে জানা গেছে, হাতিয়া ও নলচিরা ঘাটে যাত্রী পরিবহনের জন্য লাইনম্যান নামে পরিচিত কিছু ব্যক্তি প্রতিটি স্পিডবোট থেকে প্রতি ট্রিপে ১০০ টাকা করে আদায় করে থাকেন। অর্থের বিনিময়ে তারা এমন বোটকেও সিরিয়ালে জায়গা দেয় যেগুলোর বৈধ কাগজপত্র নেই। এই সিন্ডিকেট অতিরিক্ত যাত্রী বহনেও চালকদের সহায়তা করে, যার ফলে দুর্ঘটনার ঝুঁকি আরও বাড়ে।
বর্তমানে হাতিয়ার এই রুটে চলাচলকারী ৭৪টি স্পিডবোটের মধ্যে মাত্র ১৬টির বৈধ ফিটনেস সনদ রয়েছে। বাকিগুলো নিয়ম না মেনেই যাত্রী পরিবহন করছে। বেশিরভাগ স্পিডবোটে নেই প্রয়োজনীয় নিরাপত্তা সরঞ্জাম—বিশেষ করে লাইফ জ্যাকেট, যা যাত্রীদের জন্য বাধ্যতামূলক। অনেক চালক অদক্ষ ও অপ্রশিক্ষিত, বয়সও অনেক ক্ষেত্রে ২০ বছরের নিচে।
স্থানীয় বাসিন্দারা বলছেন, প্রতিদিন নদীপথে চলাচল করা মানুষগুলো যেন একটি করে ‘ভাসমান কবর’-এ উঠে বসছে, যার গন্তব্য হয়তো গন্তব্যস্থল নয়, বরং দুর্ঘটনা।
কাদের ছায়ায় চলছে এই অবৈধতা?
স্থানীয়দের অভিযোগ, কিছু প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতা ও জনপ্রতিনিধির প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ছত্রছায়ায় এই অবৈধ নৌযান ব্যবসা বহু বছর ধরে চলছে। প্রতিদিন লাখ টাকা চাঁদা আদায় হচ্ছে, অথচ জনগণের জীবনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে তেমন কোনো ব্যবস্থা দেখা যায় না।
নলচিরা ঘাট এলাকার বাসিন্দা জসীম উদ্দিন বলেন,
আমরা চাই সরকার এসব অবৈধ স্পিডবোট বন্ধ করুক। লাইসেন্স ছাড়া যেন কোনো বোট না চলে। আমরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে আর চলতে চাই না।”
প্রশাসনের বক্তব্য ও পদক্ষেপ:
হাতিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. আলাউদ্দিন বলেন,
“সম্প্রতি একটি বড় দুর্ঘটনা থেকে বেঁচে গেছেন ২৮ জন যাত্রী। এই রুটে নিরাপত্তাহীন চলাচল সত্যিই উদ্বেগজনক। আমরা নৌ পুলিশ ও কোস্টগার্ডের সমন্বয়ে একটি কমিটি গঠন করবো। কোন স্পিডবোট চলবে, কতজন যাত্রী বহন করবে সব ঠিক করে দেওয়া হবে।”
তবে স্থানীয়দের মতে, শুধুমাত্র কথায় নয়, কার্যকর উদ্যোগই পারে এই নৈরাজ্য বন্ধ করতে।
বিশেষজ্ঞদের মত:
নৌ পরিবহন ও নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা বলছেন, লাইসেন্স ও ফিটনেস সনদ ছাড়া স্পিডবোট চালানো সরাসরি আইন লঙ্ঘন। অদক্ষ চালকের হাতে এমন স্পিডবোট মানেই চলন্ত আত্মঘাতী নৌযান। এছাড়া, চেতনানাশক, অতিরিক্ত যাত্রী ও যন্ত্রপাতির ভারে অনেক বোট যে কোনো সময় ডুবে যেতে পারে।
জনগণের দাবিগুলো হলো:
1. অবৈধ ও ফিটনেসবিহীন স্পিডবোট অবিলম্বে জব্দ ও বন্ধ করা।
2. নিয়মিত যৌথ অভিযান চালানো (বিআইডব্লিউটিএ, কোস্টগার্ড, উপজেলা প্রশাসন)।
3. জনপ্রতিনিধি ও যাত্রী সাধারণকে সচেতন ও সক্রিয় করা।
4. রেজিস্টার্ড ও ফিটনেসপ্রাপ্ত বোট ছাড়া কোনো নৌযান চলবে না—এ নিয়ম কড়াকড়িভাবে বাস্তবায়ন।
5. লাইফ জ্যাকেট ছাড়া কোনো বোট যেন ঘাট ছাড়তে না পারে—‘জিরো টলারেন্স’ নীতি নিতে হবে।
হাতিয়ার নদীপথ একদিকে যেমন জীবনরেখা, অন্যদিকে তা হয়ে উঠেছে মৃত্যু ফাঁদ। এই অনিয়ম, দুর্নীতি ও অবহেলার অবসান না হলে আরও প্রাণহানির আশঙ্কা থেকেই যাবে। প্রশাসন, জনপ্রতিনিধি এবং সাধারণ মানুষের সম্মিলিত পদক্ষেপেই রক্ষা পাবে হাজারো জীবন।
যোগাযোগ
বার্তা বিভাগঃ 01788-729304, 01883-306048
ই-মেইল: shadhinsurjodoy@gmail.com
© ২০২৪ সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত | স্বাধীন সূর্যোদয় | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।