সিরিজ অনুগল্প
অনুগল্পের নাম: স্বপ্নপুরির প্রকৃতি ও জীবন
লিখেছেন: এম. আব্দুল কাইয়ুম
গ্রামের ছোট্ট বাড়ির জানালা দিয়ে সূর্যের আলো একটু একটু করে ভেসে উঠছিল। প্রাকৃতিক সৌন্দর্য আর শান্ত পরিবেশে একটি নতুন দিনের শুরু, যেন এক মধুর স্বপ্ন। গ্রামের সবার কাছে এটি ছিল অভ্যস্ত নিত্যদিনের দৃশ্য—সবুজের মাঝে ছড়িয়ে পড়া পাখিদের কলরব, নদীর ধারে ভেসে চলা ছোট ছোট নৌকা, আর মাঠে খেলা করা ছেলেমেয়েদের হাসির সুর। কিন্তু, আজ কিছু যেন বদলে গেছে।
শুভ্রা এক তরুণী, ছোটবেলা থেকেই প্রকৃতির খুব কাছাকাছি বেড়ে উঠেছে। সকাল বেলায় কৃষকদের ক্ষেতের মধ্যে শসা, পেঁপে, বেগুন কেটে এনে মায়ের সঙ্গে রান্না করত। পুকুর পাড়ে পায়ের আঙুল ডুবিয়ে সে যখন হাঁটত, তখন যেন সময় থেমে যেত। সবকিছু ছিল স্বাভাবিক। কিন্তু গত কিছু মাসে, কিছুটা অস্বস্তি অনুভব করছিল শুভ্রা। প্রকৃতির মাঝে কিছু পরিবর্তন আসতে শুরু করেছিল—বৃক্ষগুলো যেমন আগে ছিল, তেমন আর ছিল না; পাখির কলতানও অনেক কমে গেছে। নদী এক সময় যেমন ছিল, আজকাল ঠিক তেমন নয়। পানি তলিয়ে গেছে, মাছ কমে গেছে।
একদিন সকালে শুভ্রা দেখল, মাঠে বসে শষ্যের গাছের পাশে এক বৃদ্ধ কৃষক মাথা নিচু করে কাজ করছেন। তার হাতের আঙুলগুলো এক একটি শলাকা যেন ভেঙে পড়ার মতো—অসহ্য যন্ত্রণায় কাঁপছে। শুভ্রা কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করল, “চাচা, কেমন আছেন? কী করছেন এখানে?”বৃদ্ধ কৃষক মাথা তুলে বললেন, “বেটি, আগে যে আবাদে ফলন হতো, সে ফলন আর হচ্ছে না। জমির মাটি এত কঠিন হয়ে গেছে, পানি আর সেঁচ দেওয়া যাচ্ছে না। পাখিরাও এখন আসে না, আর সেই পুরোনো নৌকাগুলোও পানির অভাবে দাঁড়িয়ে পড়ে থাকে। জানো, শুভ্রা, বৃষ্টি খুব কম হয়ে গেছে। জলবায়ু বদলে গেছে, প্রকৃতি আর আগের মতো নেই।”
শুভ্রা চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছিল, বুঝতে পারছিল না কীভাবে এসব পরিবর্তন এত দ্রুত ঘটেছে। শহরের দূষণ, প্লাস্টিকের আবর্জনা, বৃক্ষহীনতা—এ সবকিছুর ক্ষতিকর প্রভাব তো এখন তাদের গাঁয়ে এসে পড়েছে।
তবে, শুভ্রা একদিন ঠিক করল—সে কিছু করতে পারবে। তার ছোট্ট গ্রামে, তার আশেপাশের মানুষদের সঙ্গে মিলিত হয়ে গাছ লাগানোর এক পরিকল্পনা তৈরি করল। স্থানীয় স্কুলের শিক্ষকদের সহায়তায়, শিক্ষার্থীদের নিয়ে বিভিন্ন গাছের চারা লাগাতে শুরু করল। পাশাপাশি, গ্রামের সবাইকে সচেতন করতে শুরু করল—প্রাকৃতিক ভারসাম্য ফেরাতে দরকার পরিবেশবান্ধব জীবনযাপন।
মহাসড়কের পাশের জমিতে, নদীর তীরে, মাঠের চারপাশে এমন হাজারো বৃক্ষ রোপণ করা হল। শুরুতে একটু ধীরে চললেও, ধীরে ধীরে গ্রামের মানুষ, যুবক-যুবতীরা সবাই এক হয়ে প্রকৃতি
রক্ষার কাজে নিয়োজিত হল। তারা বুঝতে পারল, প্রকৃতির শাসনে তারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, কিন্তু একে রক্ষা করতে তাদেরই উদ্যোগ নিতে হবে। তাদের হাতের কাজ আর ভালোবাসায় ফিরে এল সেই পুরনো গ্রামের শোভা।
এভাবে, শুভ্রা, তার গ্রামবাসীদের সহায়তায়, প্রকৃতির মাঝে আবারো একটি নতুন জীবন ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হল।
প্রকৃতির ভালোবাসায় ছড়িয়ে পড়ল নতুন গান—শুধু একটি গাছ নয়, একে একে ছোট ছোট পরিবর্তনে প্রকৃতির রূপ আবার ফিরে আসল। এটা শুধু গ্রামবাসীর নয়, পুরো স্বপ্নপুরির ইতিহাসের একটি নতুন অধ্যায় হয়ে রচিত হল।